ভয়েস এশিয়ান, ০৪ জুন, ২০২৩।। তীব্র তাপদাহে বিপর্যস্ত দেশ। দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে তাপদাহের কারণে অসুস্থতা বাড়ার পাশাপাশি রাজধানীর বেশ কিছু স্থানে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি ফ্লাইওভার থেকে বাইক নিয়ে নামার সময় দুর্ঘটনার শিকার হন রাজু (ছদ্মনাম)।
তিনি বলেন, ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় হঠাৎ করেই আমার চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে যায়। এরপর নিজেকে হাসপাতালে দেখতে পাই। আমার মাথায় ৬টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। সড়কে এ ধরনের দুর্ঘটনা কী অস্বাভাবিক গরমের কারণে?
‘তীব্র গরমে এভাবে হঠাৎ করেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার বিষয়টি খুব স্বাভাবিক, যদি আপনি এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত না থাকেন।’-কথা বলছিলেন সিলেটের ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ। তিনি বলেন, ঢাকার নিকটবর্তী সাভার বা মানিকগঞ্জের তুলনায় তাপমাত্রা কমপক্ষে ৫ ডিগ্রি বেশি থাকে। ঘনবসতি, উঁচু দালান, গাছহীন এই শহরে গত ১৭ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৬ শতাংশ এবং শহরের আয়তন বেড়েছে ৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে এই সময়ে শহরের জলধারাগুলো ভরাট করে বড় বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে। এই শহরটি বর্তমানে একটি হিট আইল্যান্ড যেখানে বনায়ন বা গাছপালা কম থাকায় হিট ডাম্পিং কোনো ম্যাকানিজম নেই।
চলতি তাপদাহকে ‘পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি’ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের স্বাভাবিক শরীরের তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি নিয়ে ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৫ ডিগ্রি বেড়ে যায়। শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রির বেশি হয়ে গেলে হিট স্টক হবে। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ৩টি প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, যার একটি হিট স্টোক। এ ছাড়াও হিট স্ট্রেস এবং হিট ক্রাম্পস হতে পারে।
তিনি বলেন, ফ্লাইওভারে বাইক দুর্ঘটনার যেই কথাটি বলা হচ্ছে, সেটি খুব সম্ভবত হিট স্ট্রেস। এমন অবস্থায় ব্রেন টেম্পারেচার বেড়ে যায় এবং আমরা কানে অদ্ভুত শব্দ শুনতে পারি। বডি মুভমেন্টও বাধাগ্রস্ত হয়। কেননা আমাদের সব কাজ সম্পাদন হয় ব্রেন থেকে।
এ ছাড়াও আবদ্ধ অবস্থায় অনেক মানুষ থাকলে সেটি অনেকটা মাইক্রো ওভেনের মতই কাজ করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ডা. মনি লাল আইচ বলেন, বডি কোর টেম্পারেচার যদি বেড়ে যায়, তা হলে আমরা ১৭ শতাংশ কর্মক্ষমতা হারাই। এ সময় ২-৩ লিটার পানি না খেলে সে খুবই অস্বাভাবিক অবস্থা অনুভব করবে। আর শুধু পানি খেলেও এই সমস্যার সমাধান হবে না। তাকে স্যালাইন অথবা চিনি ও লবণ মিশ্রিত পানি খেতে হবে।
এই তাপদাহে সবচেয়ে বিপদে রয়েছেন সেই মানুষগুলো, যাদের সারা দিন ঘরের বাইরে থেকে কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে শ্রমিকরা। তাদের ক্ষেত্রে এই তাপদাহের প্রভাব অনেক বেশি বলে মনে করেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এই তীব্র গরমে নিয়মিত নিরাপদ পানি ও স্যালাইনের ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের প্রতি ২ ঘণ্টায় কমপক্ষে আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে হবে ছায়ায়। না হলে ব্রেনের টেম্পারেচার বেড়ে গেলে শুরুতে মাথা ব্যথা এবং এরপর অন্যান্য সমস্যা প্রকট হবে তাদের জন্য।
এ সমস্যার সমাধান হিসেবে কর্মঘণ্টা পরিবর্তন এবং নিয়মিত বিরতিতে বিশ্রামের পরামর্শ প্রদান করেন তিনি। তবে এই তীব্র তাপদাহ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সক্রিয় হয়ে নির্দেশনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তীব্র তাপদাহে সবচেয়ে সমস্যার মধ্যে আছে শিশু ও বৃদ্ধরা। ৬৫ বছর বয়সি কাপড় ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, গরমের তীব্রতা অনেক। এমন গরম এর আগে দেখিনি। এই গরমের মধ্যে বারবার লোডশেডিংয়ের কারণে শিশু ও বৃদ্ধরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। গরম প্রকৃতির বিষয়। কীভাবে কমবে জানা নেই। তবে লোডশেডিং এই গরমে কম হলে মানুষ কিছুটা সুস্থ থাকতে পারবে। দেখুন, আমার সারা শরীর ভিজে রয়েছে। এভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি।
কারওয়ান বাজারে খালি গায়ে বসে ছিলেন সিরাজ। লেবু বিক্রি করেন। তীব্র গরমে শরীরজুড়ে জ্বালাপোড়া করছে বলে জানান তিনি। সিরাজ বলেন, শরীরে ঘামাচি, জামাও পরতে পারছি না।
এদিকে এই তাপদাহ সহসাই কমার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক জানান, এই মৃদু থেকে তীব্র তাপদাহ আগামী ৪-৫ দিন অব্যাহত থাকবে। সেই সঙ্গে খুলনা-রাজশাহী এই অঞ্চলে তাপদাহ প্রশমিত হতে এর থেকেও কিছু বেশি সময় লাগবে।
আবহাওয়া অধিদফতর পূর্বাভাসে ঢাকা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে বয়ে যাওয়া চলমান তাপদাহ অব্যাহত থাকবে বলে জানায়। এ ছাড়াও খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগের দুয়েক জায়গায় দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ছিল ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা সবচেয়ে তীব্র থাকার সম্ভাবনা রয়েছে সোমবার, মঙ্গলবার ও বুধবার।