আমাদের সবার নিশ্চয়ই করোনা ভাইরাসের কথা মনে আছে? এতো ভুলে যাবার কথা নয়! পুরো বিশ্বটাকে একসূত্রে গেঁথে ফেলে যে রোগটি নাম তার করোনা ভাইরাস। কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক মহামারী বলতে করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ (কোভিড-১৯)-এর বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাব ও দ্রুত বিস্তারের চলমান ঘটনাটিকে নির্দেশ করা হয়। এই রোগটি একটি বিশেষ ভাইরাসের কারণে সংঘটিত হয়, যার নাম গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস ২ (সার্স-কোভি-২ ভাইরাস)। রোগটির প্রাদুর্ভাব প্রথমে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুপেই প্রদেশের উহান নগরীতে চিহ্নিত করা হয়। চীনা প্রশাসন প্রথমে উহান নগরী ও পরবর্তীতে উহানকে পরিবেষ্টনকারী হুপেই প্রদেশের অন্যান্য নগরীতে জরুরি অবরুদ্ধকরণ জারি করলেও রোগটির বিস্তার বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়, এবং এটি দ্রুত চীনের অন্যত্র এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটিকে ২০২০ সালের ১১ই মার্চ তারিখে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের একাধিক প্রকারণের উদ্ভব হয়েছে এবং বিশ্বের বহুসংখ্যক দেশে এই প্রকারণগুলি আধিপত্য বিস্তার করেছে; এদের মধ্যে আলফা, বিটা ও ডেলটা প্রকারণগুলির প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালের ২৬শে অক্টোবর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সর্বত্র ২৪ কোটি ৪৭ লক্ষেরও অধিক ব্যক্তি করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এ আক্রান্ত হওয়া ও তাদের মধ্যে প্রায় ৪৯ লক্ষ ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ার ঘটনা নিশ্চিত করা হয়েছে, ফলে এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মরণঘাতী একটি বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে।

পুরো বিশ্বে যখন একসাথে মহাতান্ডব চালিয়ে যাচ্ছিলো এই রোগটি তখন বিশ্বজুড়ে কয়েকটি শব্দও সকলের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো আর তা হল আইসোলেশন, লকডাউন কিংবা সার্কিটব্রেকার। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচালিত হলেও কাজ ছিলো অভিন্ন। ঐ সময় দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের স্বজনদের আহাজারি ছিলো চোখে পড়ার মতন। পুরো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের নিয়ে দেশে অবস্থানরত তাদের স্বজনদের চিন্তার যেন শেষ ছিলো না। প্রবাসী এই সকল বাঙ্গালীদের পাশে তখন স্ব স্ব দেশে বসবাসরত বাঙ্গালী সমাজ এগিয়ে আসে হাতে হাত রেখে সব ভেদাভেদ ভুলে। যার খবর প্রতিনিয়ত আসতে থাকে মিডিয়াগুলোতে।
ঠিক এমনই একটি ঘটনা নাড়া দিয়েছিলো পুরো বিশ্ব জুড়ে। এশিয়ার ইমার্জিং টাইগারখ্যাত সিঙ্গাপুরে যখন সার্কিটব্রেকার চলছিলো তখন বিভিন্ন ডরমেটরিতে প্রবাসীদের অবস্থা ছিলো খুবই করুন। দিনের পর দিন একই রুমে বদ্ধ থেকে যখন অস্থির ঐ সকল প্রবাসীজন ঠিক তখন তাদের পাশে সহায়তা ও মমতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে এক তরুণ চিকিৎসক মুনতাসির মান্নান চৌধুরী। ডরমেটরির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রুম বন্দী প্রবাসী এই সকল রেমিটারদের পাশে থেকে ডরমেটরি টু ডরমেটরি যেয়ে তাদের করোনা ভাইরাস সম্পর্কে অবহিত করন এবং চিকিৎসা সেবা প্রদানে তখন জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করেন মুনতাসির মান্নান চৌধুরী। তখন থেকেই সিঙ্গাপুরে বসবাসরত প্রবাসী বাঙ্গালীদের কাছে তিনি অতি জনপ্রিয় একজন হয়ে উঠেন। সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে তিনি ডাক্তার মুনতাসির ভাই হিসেবেই বেশি পরিচিত।
সিঙ্গাপুর প্রবাসীদের কাছে একটি পরিচিত নাম মুনতাসির মান্নান চৌধুরী। তিনি সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশি একজন ডাক্তার। সিঙ্গাপুরের সেংকাং জেনারেল হাসপাতালে অর্থোপেডিক স্পেশালিস্ট হিসেবে দক্ষতা এবং সুনামের সাথে কাজ করছেন মুনতাসির মান্নান।
বাংলাদেশি একজন ডাক্তার হিসেবে তিনি প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নিয়ে চিন্তা করেন। তিনি মনে করেন, সিঙ্গাপুরসহ সারা বিশ্বের প্রবাসীরা ভালো থাকলে সুস্থ থাকলে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই চিন্তা থেকেই সিঙ্গাপুরে প্রবাসীদের পাশে থাকার এবং বিনামূল্যে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।
ডা. মুনতাসির করোনার সময় থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন ডরমিটরিতে গিয়ে করোনা মোকাবিলায় সাহস যুগিয়ে পাঁশে থেকেছেন। এছাড়া ফেসবুক লাইভে বিভিন্ন সময় সিঙ্গাপুরে কর্মরত প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তখন থেকেই সিঙ্গাপুর প্রবাসী অনেক মানুষের কাছে প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি।
সম্প্রতি তিনি একটি টিম তৈরি করেছেন, যারা সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ডরমিটরিতে গিয়ে বাংলাদেশি এবং ইন্ডিয়ান প্রবাসীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। প্রতি মাসে ১/২টি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তারা চেষ্টা করেন ডরমিটরিতে গিয়ে প্রবাসীদের এই চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখতে।
তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন একটি টিমে কাজ করছি। আমাদের টিম লিডারদের মধ্যে রয়েছেন ডা. হামিদ রহমতুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক ও ডা. তৌসিফ কবির। সেবামূলক এই কার্যক্রমের সাথে আরও যুক্ত আছেন তার ছেলে দেয়ান, ইহতিমাম, ডাক্তার সন্দীপ, ইব্রাহিম, আল আমিন, ইমাম ও রাজু। আগামীতে আরও কয়েকজন ডাক্তার এই মানবিক কাজে যুক্ত হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ডা. মুনতাসির বলেন, এই মানবিক কাজটি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে আমরা গত বছরের ডিসেম্বর থেকে অভিবাসী কর্মীদের ডরমিটরি পরিদর্শন করার কার্যক্রম শুরু করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য প্রতি মাসে অন্তত একটি রবিবার সন্ধ্যায় ডরমিটরি পরিদর্শন করা এবং চিকিৎসা সেবা বা পরামর্শ প্রদান করা।
করোনাকালীন সিঙ্গাপুরে যে কয়জন প্রবাসী ডাক্তার সেই দেশের ডরমেটরিতে প্রবাসী রেমিটারদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন তাদের মধ্যে মুনতাসির মান্নানও একজন। ২০শে মার্চ সিঙ্গাপুরের পার্লামেন্টে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি হেসেং লুং করোনাকালীন কর্তব্যরত বেশ কয়েকজন ডাক্তারকে সংবর্ধনা দেন। এর মধ্যে আমাদের গর্ব আমাদের দেশের সন্তান ডাক্তার মুনতাসির মান্নান চৌধুরীও ছিলেন। পরবর্তীতে পার্লামেন্টে সিঙ্গাপুরের মানবসম্পদ মন্ত্রী ডঃ তান সি লেং তার বক্তব্যে ডাঃ মুনতাসিরের কোভিডকালীন সময়ে দৃষ্টান্তমূলক কর্মকাণ্ড, গণসংযোগ এবং গনসচেতনতামূলক কাজ ছাড়াও গত তিন বছরে প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যখাতে সেবামূলক কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
যে মানুষটি দেশের মাটিতে নয় প্রবাসে এত্তসব সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন নিভৃতে চলুননা এবার তার সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জেনে নেয়া যাক। ডাক্তার মুনতাসির মান্নান চৌধুরীর জন্ম ১৯৭৮ সালের ১৪ই জুন ঢাকায়। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী এবং মা মিসেস মোর্শেদা চৌধুরী। তার জন্মের ৩ মাসের মধ্যে তার বাবা তাদেরকে নিয়ে নাইজেরিয়া চলে যান। তার বাবাকে নাইজেরিয়াতে এক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।মুনতাসির মান্নান ৩ ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, ছোট ভাই আমেরিকাতে এক উনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ডাক্তার মুনতাসির মান্নান চৌধুরীর শৈশব কেটেছে নাইজেরিয়াতে। অতঃপর তার বয়স যখন ৬ বছর তখন তারা দেশে ফিরে আসেন। তিনি বলেন প্রবাস জীবন আমার বাবার জন্য না, কারন উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশের মাটিকে আঁকড়ে ধরেই উনি বাঁচতে চেয়েছিলেন।

এর পর থেকে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন। পরের বাকি সময়টা বিদেশে কাটে তার। মেডিক্যাল কলেজ শেষে এক বছর ইংল্যান্ডে চাকরি করে ঢাকায় ফিরে কাজ করেন এক বছর। এর পর পাড়ি জমান সিঙ্গাপুরে। এখানেই চলে তার পরবর্তী ট্রেনিং এবং বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে একজন বিশেষজ্ঞ সার্জন হিসাবে কাজ করছেন। ডা. মুনতাসির সিঙ্গাপুরে সিংহেলথের সেংকাং জেনারেল হসপিটালের একজন সিনিয়র সার্জন এবং একই সাথে Duke-NUS মেডিক্যাল স্কুলের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। ইতোমধ্যে তিনি একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক হিসাবে সিংহেলথ থেকে চারবার স্বীকৃতি পেয়েছেন।
সার্জারি সম্পর্কে তিনি বলেন এটা শুধুমাত্র আমার পেশা নয়, এটা আমার চালিকাশক্তি। আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। এই কাজটা আমি অত্যন্ত রকম ভালোবাসি। ট্রেনিংয়ের সময়টা আমার অনেক ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটেছে। এক হিসেবে আমার দিন পার হতো বাসা এবং হাসপাতাল ঘিরেই।
তিনি আরো বলেন আমার জন্মস্থান বাংলাদেশ হলেও আমার কর্মস্থান সিঙ্গাপুর। জীবিকার তাড়নায় হয়তোবা আমাকে সারাজীবন সিঙ্গাপুরেই থেকে যেতে হবে কিন্তু আমি আমার বাবার ছেলে, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। আমি সিঙ্গাপুরে বসেই আমার সেই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি। এখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা দিচ্ছি। কাজের মাঝে সময় পেলেই ছুটে যাই সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ডরমেটরিগুলোতে সেখানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দিতে। জীবনের বাকিটা সময় এভাবেই রোগীদের সেবায় কাটিয়ে দিতে চান আমাদের দেশের গর্ব সিঙ্গাপুর প্রবাসী ডাক্তার মুনতাসির মান্নান চৌধুরী।
এক ছেলে, এক মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে বেশ ভালভাবেই তার সময় কেটে যাচ্ছে সিঙ্গাপুরে। তবুও কখনো কখনো হারিয়ে যান স্মৃতির অতল গভীরে। মনের কোণে উঁকি দেয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মতামত জানাতে লেখকের ইমেইলে সরাসরি মেইল করতে পারেন অথবা WhatsApp এ কানেক্ট হতে পারেন। মেইলঃ jewelkb7@gmail.com । WhatsApp Number: +88 01637 174488