ভয়েস এশিয়ান, ০৫ অগাস্ট, ২০২০।। করোনা মহামারীর মধ্যেই রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি'র দেয়া তথ্যে দেখা যায় গত বছর জুলাইয়ের মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে যে পরিমাণ রপ্তানি আয় এসেছে এবার জুলাইয়ে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ রপ্তানি আয় হয়েছে। বছর ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক পাঁচ নয় শতাংশ। করোনায় যখন চাহিদা-যোগানের হিসাবে বাজার নিম্নমুখী বলে দেশি বিদেশি গবেষণা সংস্থাগুলোর নানা শঙ্কা ঠিক তখন রপ্তানি বাজারে ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ।
বুধবার (৫ আগস্ট) গণমাধ্যমে পাঠানো ইপিবি'র তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় এসেছে ৩৯১ কোটি ডলার। গতবছর জুলাইয়ে এই পরিমাণ ছিল ৩৮৮ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। অর্থাৎ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০.৫৯ শতাংশ। করোনাভাইরাসের দাপটে বাজার হারাতে হবে ধরেই মাসভিত্তিক যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্জন হয়েছে ১৩.৩৯ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ এ বছর জুলাইয়ে পণ্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ২৪৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার, সেখানে আয় হয়েছে ৩৯১ কোটি ডলার।
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পও ঈঙ্গিত দিয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর। গত অর্থবছরের শেষ মাস অর্থাৎ গেল জুনে যেখানে এ খাতের মোট (ওভেন ও নীটওয়্যার) রপ্তানি আয় ছিল ২২৪ কোটি ডলার সেখানে এর পরের মাসে (জুলাই) আয় হল ৩২৪ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে এখাতের রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ (৪৪.৮৫)। আর মাসভিত্তিক 'সাবধানী' লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এই আয় ১৪.১৮ শতাংশ বেশি। এরমধ্যে নীটওয়্যারের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪.৩০ শতাংশ। আর মাস ধরে নির্ধারণ করা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এই আয় ২৪.৫৯ শতাংশ বেশি। তবে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতেই আটকে আছে ওভেন পোশাকের রপ্তানি আয়ের চাকা। জুলাই মাসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি আয় হলেও এখনও ৮.৪৩ শতাংশ ঋনাত্মক প্রবৃদ্ধিতে এই পোশাকের আয়। অর্থাৎ আয় কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। গত মার্চ থেকেই পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছিল এই অর্থবছরে পোশাকের চাহিদা কমে যাবে ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। ঠিক এমন সময় পোশাকের এই অর্জন প্রায় গেল বছরের জুলাই মাসের সমান। গতবছর জুলাইয়ে এখাতের রপ্তানি আয় হয়েছে এবারের চেয়ে মাত্র ২ শতাংশ বেশি (৩৩১ কোটি ৪ লাখ ডলার)।
অবশ্য চলতি বছরের শুরু থেকে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির খপ্পরে পড়া এই খাতটি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে আসছিল মে থেকেই। তথ্যে দেখা যায়, বছর ব্যবধানে গত জানুয়ারিতে এখাতের রপ্তানি কমে প্রায় ৩ শতাংশ (২.৯৮)। এর পরের মাসে কমে ৪.২৮ শতাংশ। করোনার কারণে এর পরের মাস মার্চে কমে যায় ২০.১৪ শতাংশ। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আসে এপ্রিলে। ওই মাসে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় কমে ৮৫.২৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৯ সালের এপ্রিলে যেখানে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় হয়েছিল ২৫৩ কোটি ৯২ লাখ ডলার, সেখানে ২০২০'র এপ্রিলে রপ্তানি আয় হয় মাত্র ৩৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। এরপর মে-তে রপ্তানি প্রায় সাড়ে ৩ গুন বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩ কোটি ডলারে। ওই মাসে ৬২.০৬ শতাংশ ঋনাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। তবে, এরপরের মাসে বেশ বেড়ে যায় রপ্তানি আয়। জুনে রপ্তানি আয় আসে ২২৪ কোটি ডলার। জুন মাসে যেখানে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৬৩ শতাংশ, সেখানে জুলাই তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৯৮ শতাংশে।
পোশাকখাতের এই ঘুরে দাঁড়ানোকে বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে আমাদের রপ্তানি খাতটি এখনো যেহেতু পোশাক খাত নির্ভর, এ ধরনের ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসাটি অবশ্যই এটি ইঙ্গিত করে যে, রপ্তানি খাত ধীরে ধীরে আমাদের বৈশ্বিক ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে পারছে। এভাবে চললে তৈরি পোশাকখাতে আগামীতে শ্রমিকদের পূর্ণ মজুরি দিয়ে কারখানাগুলো চালাতে পারবেন উদ্যোক্তারা, শ্রমিকদের স্বল্প সময়ে কাজ করা অথবা ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনায় তাদের আর যেতে হবে না। এমনকি উদ্যোক্তাদের, সরকারের সহযোগিতারও আর প্রয়োজন হবে না।
দেশের ২য় বৃহত্তম রপ্তানিমুখী খাত চামড়া শিল্পও ছাড়িয়ে গেছে লক্ষ্যমাত্রা। গেল জুলাইয়ে এ খাত থেকে আয় আশা করা হয়েছিল ৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, সেখানে আয় এসেছে ৯ কোটি (৮.৯৯ কোটি) ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬.২২ শতাংশ বেশি আয় এসেছে। তবে, লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও এখনও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতেই ঘুরছে এখাতের চাকা। এই মাসে চামড়াজাত পণ্য ও প্রক্রিয়াজাত চামড়ার রপ্তানি পিছিয়ে থাকলেও আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে ফুটওয়্যারের রপ্তানি আয়। প্রত্যাশার চেয়ে ৩১.৩৪ শতাংশ বেশি হয়েছে। তবে, লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করতে পারেনি নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ঘরে থাকা সম্ভাবনা জাগানো দেশের প্লাস্টিক শিল্প।
পোশাকখাতের বাইরে রপ্তানি বাজারে অন্য শিল্পের মুখ থুবড়ে পড়াকে টেকসই আয়ের পথে বাধা হিসেবে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট-পিআরআই' নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, সাসটেইনেবিলিটি নন আরএমজি সেক্টরের জন্য একটি বিশাল প্রশ্ন। দেখা যায় কিছু কিছু খাত হঠাৎ করে একটু ভালো করে বেশ কিছুদিন, তারপর আবার মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তবে আমি আশাবাদী যে, আস্তে আস্তে আমরা এ ধাক্কা থেকে বেরিয়ে আসবো।
এই করোনাকালে খাদ্যপণ্যের মধ্যে শুকনো খাবারের (ড্রাই ফুড) রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০৯.৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুলাইয়ে যেখানে এখাতের রপ্তানি আয় এসেছিল ১ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, সেখানে এবছর জুলাইয়ে এসেছে এর দ্বিগুণ (৩ কোটি ৭ লাখ ডলার)।
বেশ ধরনের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি। এ খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮.২৩ শতাংশ। এবার জুলাইয়ে এখাত থেকে আয় এসেছে ১০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার; গতবছর জুলাইয়ে এসেছিল ৭ কোটি ৪৮ লাখ ডলার।
এদিকে, জুলাই মাসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলেও আয় বেড়েছে আসবাবপত্রের রপ্তানিতে। এ খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬.৪৭ শতাংশ। যদিও এ খাত থেকে আয়ের প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি। ৮৪ লাখ ডলারের প্রত্যাশার বিপরীতে আয় এসেছে ৬৫ লাখ ডলার। গতবছর জুলাইয়ে এখাতের আয় ছিল ৫১ লাখ ডলার।
হিমায়িত মাছ রপ্তানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৪.৭৭ শতাংশ, চা'র রপ্তানি বেড়েছে ৭৮.৯৫ শতাংশ, মসলার বেড়েছে ৪১.৪৩ শতাংশ। বাজার দখলে সম্ভাবনার জানান দেয়া প্রসাধনী পণ্যের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২শ' শতাংশ। রপ্তানি বাজারে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪৬.৩৪ শতাংশ। হস্তশিল্প পণ্যের রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫৭.২২ শতাংশ।